ভবন নির্মাণে লাগবে মাত্র ৪ স্তরের অনুমোদন

এখন থেকে ভবন নির্মাণে ১৬ স্তরের অনুমোদন লাগবে না। জটিলতা ও ভোগান্তি এড়াতে অনুমোদনের প্রক্রিয়া কমিয়ে চার স্তরে আনা হচ্ছে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ও খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষভুক্ত (কেডিএ) এলাকার মতো স্থানগুলোতে ভবনের নকশা অনুমোদনে এই যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

এখন থেকে ভবন নির্মাণের জন্য- ভূমি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ছাড়পত্র নিতে হবে। ভবনের উচ্চতার বিষয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন কর্তৃপক্ষের অনাপত্তিপত্র নিতে হবে। বঙ্গভবন, প্র্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ বিশেষ বিশেষ এলাকা বা স্পর্শকাতর এলাকার পাশে কোনো ইমারত নির্মাণের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বাহিনীর অনাপত্তিপত্র লাগবে। আর দশ তলা ভবনের ঊর্ধ্বে হলে ফায়ার সার্ভিসের অনাপত্তিপত্র লাগবে।

বুধবার সচিবালয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) সমন্বয়ে রাজউক ও সিডিএর সেবা সহজীকরণের ওপর মতবিনিময় সভা শেষে সাংবাদিকদের এ সিদ্ধান্তের কথা জানান গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম। এ সময় বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী মো. আমিনুল ইসলাম, গৃহায়ন ও গণপূর্ত সচিব মো. শহীদ উল্লা খন্দকারসহ অন্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

সভা শেষে মন্ত্রী বলেন, আমরা আজকে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই সিদ্ধান্তগুলো মানুষের সেবার জন্য, সেবা সহজীকরণের জন্য। আমি যদি আরো খোলামেলাভাবে বলি, দীর্ঘদিনের অনাকাঙ্ক্ষিত ভোগান্তি থেকে পরিত্রাণ দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আমরা যুগান্তকারী কয়েকটি সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

তিনি বলেন, ‘রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মতো আমাদের অন্যান্য উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ যেগুলো রয়েছে, সেগুলো থেকে ভবন নির্মাণের জন্য নকশা অনুমোদন নিতে হয়। এই অনুমোদন প্রক্রিয়ায় ১৬টি স্তর অতিক্রম করতে হতো। এই ১৬টি স্তর অতিক্রম করতে গিয়ে সীমাহীন ভোগান্তির অভিযোগ জনগণের ছিল। আমরা এটি গভীরভাবে পর্যালোচনা করেছি। বিডা আমাদের এ বিষয়ে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করেছে।’

গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা দেখেছি, গতানুগতিক যে ১৬টি স্তর, এর কোনো আবশ্যকতা নেই। কেবল সেবাপ্রার্থীদের ভোগান্তি বাড়ানো ও নামকাওয়াস্তে একটি পদ্ধতির ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কিছু নয়। আমরা আজ সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ১৬টি স্তরের পরিবর্তে চারটি স্তর প্রয়োজন হবে এই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে। আজকে আমরা ১২টি স্তরকে বাদ দিয়ে দিচ্ছি। এই ১২টি স্তরের কোনো প্রয়োজন নেই।’

তিনি বলেন, ‘যখন কোনো সেবাপ্রার্থীকে এই ১২টি প্রক্রিয়ায় যেতে হতো, তখন অকারণে অনাহুতভাবে তার সীমাহীন ভোগান্তি হতো। সেই ভোগান্তি দূর করে সহজ করার মধ্য দিয়ে জনসেবাকে মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়া আমাদের লক্ষ্য।’

মন্ত্রী বলেন, এখন ভবন নির্মাণের নকশা অনুমোদনের জন্য সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, বিদ্যুৎ বিতরণকারী কর্তৃপক্ষ, গ্যাস সরবরাহকারী কর্তৃপক্ষ, ওয়াসা, পুলিশ, ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ ১২টি সংস্থার অনুমোদন আর প্রয়োজন হবে না।

ভবনের নকশা অনুমোদনের জন্য চারটি স্তর তুলে ধরে গৃহায়ন মন্ত্রী বলেন, ভূমি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ছাড়পত্র নিতে হবে। ভবনের উচ্চতার বিষয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন কর্তৃপক্ষের অনাপত্তিপত্র নিতে হবে, তবে এটাকেও আমরা সহজ করে দিয়েছি। যে এলাকা প্লেন চলাচলের পথ নয়, সেই এলাকা নির্ণয় করে এত সহজ করে দেব যে, কর্তৃপক্ষ ম্যাপটাকে ফলো করে প্ল্যান দিতে পারবেন। এই অঞ্চল প্লেন চলাচলের জায়গা নয়, এ বিষয়ে একটা গেজেট নোটিফিকেশন লাগবে। এটি আমরা দু-একদিনের মধ্যে সম্পন্ন করব। যেখানে প্লেন চলাচল নেই, সেখানে অনাপত্তিপত্র আনতে যেতে হবে না। বঙ্গভবন, প্র্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ বিশেষ বিশেষ এলাকা বা স্পর্শকাতর এলাকার পাশে কোনো ইমারত নির্মাণের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বাহিনীর অনাপত্তিপত্র লাগবে। আর দশ তলা ভবনের ঊর্ধ্বে হলে ফায়ার সার্ভিসের অনাপত্তিপত্র লাগবে। এছাড়া, কোনো প্রয়োজন নেই।

এ সময় মন্ত্রী হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, যারা নিয়মনীতি না মেনে ভবন নির্মাণ করছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে।

রেজাউল করিম বলেন, ‘একটা প্ল্যান পাসের জন্য সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে আগে সর্বোচ্চ সময় লাগতো ১৫০ দিন। এই ১৫০ দিন থেকে আমরা কমিয়ে ৫৩ দিনে নিয়ে আসছি। তাহলে কতো বড় পরিবর্তন নিয়ে আসছি। এক্ষেত্রে ব্যয় কমে যাচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘প্রোপারলি হলে আপনি সাত দিনের মধ্যে রেজাল্ট পেয়ে যেতে পারেন। আমরা সর্বোচ্চ সীমাটা করেছি ৫৩ দিন।’

গণপূর্তমন্ত্রী বলেন, নকশা অনুমোদন প্রক্রিয়ায় অটোমেশন পদ্ধতি কার্যকর করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে যা যা প্রয়োজন, সেগুলো দিয়েই প্রত্যেকে আবেদন করবেন। এই চারটি রিকয়্যারমেন্ট যদি তিনি ফুলফিল না করেন, তবে তার আবেদনটাই অনলাইনে অ্যাকসেপ্ট হবে না।

মন্ত্রী বলেন, প্রতিদিন হাজার হাজার লোক চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে গিয়ে, রাজউকে গিয়ে ভিড় করেন। প্রতিটি রুমে ঢুকে যান, কর্মকর্তারা কাজও করতে পারেন না। কারণ, এতোগুলো লোক এলে তাদের কথা শুনতে হয়। সমস্যা শুনতে হয়। তাকে সমাধান দিতে হয়। ফাইল আসতে হয়। নানা রকম ভোগান্তি। এই অটোমেশন পদ্ধতি চালু করার পর দেখা যাবে, কাউকে সরাসরি রাজউকে বা চউকে আসার দরকার নেই। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নির্বিঘ্নে কাজ করবেন। আমাদের সময় বাঁচবে।

তিনি বলেন, আমাদের দপ্তর থেকে ম্যাসেজ চলে যাবে আপনার প্ল্যান অ্যাপ্রুভড বা ডিস-অ্যাপ্রুভড হয়েছে। আপনি কালেক্ট করেন বা ডাউনলোড করে নিতে পারেন। একেবারে সহজীকরণ পদ্ধতির জায়গায় আমরা নিয়ে আসছি। এতে মানুষের ভোগান্তি কমল, ব্যয় কমল। এখন কোনো দালালের কাছে যেতে হবে না। অন্যায় পথে কাউকে কনভিন্স করার চেষ্টা করা লাগবে না।’

আগামী ১ মে থেকে আর কোনো ম্যানুয়ালি নকশা অনুমোদন বা অন্য কোনো আবেদনের সুযোগ থাকবে না বলেও জানান রেজাউল করিম।

মন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশে ইমারত নির্মাণের ক্ষেত্রে আমরা অনাকাঙ্ক্ষিত অনেক ঘটনা দেখি। ইঞ্জিনিয়ারদের ব্যর্থতা, ডেভেলপারদের ব্যর্থতা, অতিলোভী কিছু লোকদের ব্যর্থতা, আমরা যারা নিজেরা দালান করতে চাই তাদের ব্যর্থতা। সবকিছু মিলিয়ে অকালে শ্রমিকদের প্রাণ ঝরে যায়, ভবনে বসবাসকারী সুন্দর পরিবারটি ধ্বংস হয়ে যায়। এজন্য প্রতিকারের ব্যবস্থা বাংলাদেশে আইনে ওরকম নেই। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সব ইমারত নির্মাণের ক্ষেত্রে ইন্সুরেন্স বাধ্যতামূলক। ইন্সুরেন্সেরটা হলে যিনি ভবনটা নির্মাণের দায়িত্ব নিচ্ছেন তিনিও যেনতেনভাবে নির্মাণ করতে চাইবেন না। কারণ, তিনি ভাববেন, এই ভবনটা ধসে গেলে আমার এত টাকার ইন্সুরেন্স পে করতে হবে। অথবা কেউ যদি অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থার শিকার হন, তার পরিবারও একটা নিশ্চয়তা পাবে। এই ইনস্যুরেন্সের ক্ষতিপূরণ তাকে দিতে হবে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ইনস্যুরেন্স পদ্ধতি আছে। আমরা সেটি ইম্পোজ করলাম।’

মন্ত্রী বলেন, এ প্রক্রিয়াগুলো সম্পন্ন করতে পারলে আন্তর্জাতিকভাবে কোনো দেশকে অ্যাসেস করার যে স্কোরিং সেখানে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়ে যাবে।

সুত্র: রাইজিংবিডি